উত্তরঃ বিশ্বাস শব্দটির অর্থ অনেক গভীর। বিশ্বাস মানুষের মনের একটি বিমূর্ত ভাবনা। জন্মলগ্ন থেকে মানুষ যা দেখে, যা শোনে, যা বোঝে এবং যা থেকে তার ধারনা নেয় তা থেকেই তার আদর্শ গড়ে ওঠে। আদর্শ মানুষকে বিশ্বাস গড়ে তুলতে অনুপ্রানিত করে। দৈনন্দিন কর্মজীবনে মানুষ প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে পরিচিত হয়, আদান প্রদান করে, সুবিধা ভোগ করে বা করতে পারে এসব থেকে সে ঐ উপাদানের উপর আস্থা রাখতে পারে। আস্থা বিশ্বাসের জন্ম দেয় অর্থাৎ ব্যক্তি যখন কোন কিছুর উপর নির্ভর করে , যা তাকে সহজ জীবন দিতে পারে বা তার আশা প্রত্যাসাকে বাস্তবায়িত করতে পারে তখনই সেই বস্তু বা ধারনা বা আদর্শ বা কৌশলের উপর তার বিশ্বাস জন্ম নেয়। সে ঐ উপাদানের উপর ভরসা করে বা বিশ্বাস রাখে। এভাবে মানুষ কোন আদর্শ বা নিয়ম বা রীতির বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তখন ঐসব নিয়ম নীতি বা কর্মপ্রেরনার উৎসকে আমরা ব্যক্তির বিশ্বাস বলি। বিশ্বাস থেকে ব্যক্তির নৈতিকতার সৃষ্টি হয়। মানুষ যদি তার কর্মে নিজের বিশ্বাসের প্রতিফলন প্রতিফলন ঘটাতে পারে সে উৎসাহী হয় এবং যদি না পারে, সে হতাস হয।
যেমনঃ মনেকরি একজন ব্যক্তি সততায় বিশ্বাসী কিন্ত তিনি সত্যি কথা বললেই বিপদে পরেন, এমন যদি হয় পরিস্তিতি তখন তার আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরে এবং দিনে দিনে তিনি হতাস হয়ে পরেন।
সুতরাং মানুষের মধ্যে শুধু বিশ্বাস গড়ে তুললেই হবে না, সমাজে তা প্রতিফলনের সুযোগ থাকা চাই।
মানুষের বিশ্বাস সমূহ তার মৌলিক সত্ত্বায় অবস্থান করে। বিষয় গুলো আমরা মানুষের মধ্যে সাধারনত এভাবে দেখতে পাই, যেমন - মৌলিক ধারনা, শ্রদ্ধাবোধ, আচরন, গবেষণা তত্ত্ব, ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব, কর্মসহায়ক গবেষণা, অনুশীলন, ব্যবহারিক জ্ঞান, পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান যা মানুষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে এবং সন্তষ্ট হয়।
বিশ্বাসের উৎপত্তি হয় ব্যক্তির মানসিক সংগঠন থেকে। যেমন- একজন প্রশিক্ষনার্থী বি এড ডিগ্রী অর্জন করার সাথে সাথে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কল্যানমুখী ও সৃজনশীল শিখনের জন্য শিক্ষন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ হন। এ উদ্দেশে তিনি তার চিন্তা চেতনায়, কাজে-কর্মে সর্বত্র শিক্ষার্থীর ইতিবাচক শিখন সংক্রান্ত যাবতিয় বিশ্বাস প্রয়োগ করতে থাকেন। এখানে বি এড শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যখন সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন তখন বিষয়বস্তু, শিক্ষার পরিবেশ, পারস্পরিক মিখষ্ক্রিয়া ইত্যাদি সবকিছুই তার মানসিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ন উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। ফলে শিক্ষার্থীর কল্যানমূখী শিক্ষনের প্রতি তিনি ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছেন। কারন তার বিশ্বাস এভাবে গড়ে উঠেছে। সুতরাং দেখা যায় ব্যক্তির বিশ্বাস তার জীবন পরিচালনায় ও দৃষ্টি ভঙ্গি গঠনে গভীর ভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
বিশ্বাসের সাথে মানুষের আধ্যাতিক চেতনা, নীতিবোধ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহ্যগত এবং যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত। একজন শিক্ষকের বিশ্বাস তার পেশাগত কাজে তাকে অনুপ্রেরনা যোগায়। এ কারনে ইতিবাচক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য কারন এ বিশ্বাসই তার পেশাগত জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে।
বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কোন কাজ করলে সে কাজের কর্মমূল্য বহুগুন বৃদ্ধি পায়। কারন সে কাজের মধ্যদিয়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ ঘটে। ফলে ব্যক্তি সেখানে স্বীকৃতি পায়, কর্মপরিচালনা হয়ে উঠে তখন আনন্দদায়ক, সহজ ও অর্থপূর্ণ।
বিশ্বাসের ভিত্তির উপর গড়ে উঠে মূল্যবোধের কাঠামো।মানুষ তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করে। জীবনের প্রতিটি স্তরে বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে মূল্যবোধকে প্রয়োগ করে। যেমন একজন ব্যক্তি মানবিকতায় বিশ্বাসী। তিনি জীবজগতের প্রতি সবসময় সহানুভূতিশীল। এখানে তার বিশ্বাস তাকে মানবিক আচরন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সে কারনে তিনি মানবিক আচরনকে গুরুত্ব দেন বা মূল্য দেন। এটাই তার মূল্যবোধ। মূল্যবোধ ব্যক্তির শক্তি বা ক্ষমতা যার গুনে সে নিজের বৈশিষ্টকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং যা সে চায় তাই অন্যের মধ্যে বিকশিত করতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যবোধের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। বিষয়বস্তু, শিক্ষকের গুনাবলী, শিখন পরিবেশ এসব উপাদান শিক্ষার্থীর বিশ্বাস গঠনে প্রভাব বিস্তার করে। বিদ্যালয়ে যে বিশ্বাস সে অর্জন করব, তার উপর তার মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। যে ব্যক্তি ইতিবাচক বা কল্যানকর গুনাবলীকে মূল্য দেন তিনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্য। কারন তার মূল্যবোধ ও দর্শন দ্বারা তিনি শিক্ষার্থীদের প্রভাবান্বিত করতে পারেন।
মূল্যবোধ জাতীয়দর্শন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি জীবনকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার নীতিমালা বা সার্বিক উন্নয়নের সহায়ক শক্তি। আধুনিক ধারনা অনুযায়ী মূল্যবোধ হলো কতগুলো জৈব মানসিক সংগঠনের এমন এক সমন্বয় যা পরিবেশের বহু অংশকে সক্রিয়তার দিক থেকে সমগুন সম্পন্ন করে তোলে এবং ব্যক্তির মধ্যে উপযুক্ত আচরন সৃষ্টি করে। এ ধারনাটিকে বিশ্লেষন করলে দেখা যায় পরিবেশ ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জৈব মানসিক প্রবনতা যা সাধারন ধর্মী ও সামন্ঞ্জস্য পূর্ন আচরন সৃষ্টি করে তাকে মূল্যবোধ বলা হয়।
একজন শিক্ষক শুধু বিষয়বস্তু শিক্ষনই দেন না, তিনি শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করেন, শ্রেনী পরিবেশ নিয়ন্ত্রন করেন, শিক্ষার্থীর যে কোন ধরনের সমস্যায় নির্দেশনা দেন, এমনকি তার সাথে শিক্ষকের টাকা-পয়সা লেনদেনও করতে হয়। প্রতিক্ষেত্রে শিক্ষকের আচরন শিক্ষার্থীকে প্রভাবান্বিত করে। উন্নত ও আর্দশ ব্যক্তি তথা জাতি গঠন শিক্ষার লক্ষ। সুতরাং এ লক্ষ সামনে রেখে একজন শিক্ষক নিজ বৈশিষ্টে যথার্থ মূল্যবোধ গড়ে তুলবেন যেন সমাজে প্রত্যাশিত ও সমগুনসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে তিনি সক্ষম হন।